জীবন না গেলে মেলে না পদচারী সেতু!

Passenger Voice    |    ০১:১৮ পিএম, ২০২৪-০৪-৩০


জীবন না গেলে মেলে না পদচারী সেতু!

২০১৯ সালের ১৯ মার্চ। রাজধানী বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেটের অপর পাশে রাস্তা পারের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র আবরার আহাম্মেদ চৌধুরী। বেপরোয়া গতিতে এসে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাস তাকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এর দুদিন পর ওই স্থানে ফুটওভারব্রিজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মেয়র আতিকুল ইসলাম।

প্রগতি সরণির যমুনা ফিউচার পার্ক সংলগ্ন এ জায়গাটিতে একটি পদচারী সেতুর দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যমুনা ফিউচার পার্কের মতো বড় শপিংমল, বসুন্ধরার মতো কয়েক লাখ মানুষ বসবাস করা আবাসিক এলাকা থাকায় প্রচুর মানুষ সেখানে প্রতিদিন রাস্তা পারাপার করে। অথচ একটি পদচারী সেতু পাওয়ার জন্য আবরারের জীবন যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ব্রিজটি কতটা প্রয়োজন ছিল তা স্পষ্ট হয় উদ্বোধনের কয়েকদিনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ছবিতে। সেখানে দেখা যায়, পুরো ফুটওভারব্রিজ জুড়ে শুধু মানুষ, সিঁড়িতে দীর্ঘ লাইন ধরে উঠছে মানুষ। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ এতদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পার হতো।

এমন ঘটনা রয়েছে আরও কয়েকটি। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই দুই বাসের রেষারেষিতে নিহত হন শহীদ রমিজ উদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পরে সেখানে আন্ডারপাস স্থাপন করা হয়। ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর রাজধানীর গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান মারা যান। পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সেখানে একটি পদচারী সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।

রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত সড়ক প্রগতি সরণির বাড্ডা লিংক রোড, হোসেন মার্কেট, সুবাস্তু, রামপুরাসহ কয়েকটি পয়েন্টেও পদচারী সেতু একান্ত প্রয়োজন। বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে পার হলেও নেই কোনো পদচারী সেতু। এলাকাবাসী কিংবা এখানে নিয়মিত চলাচলকারীরা বিভিন্নভাবে দাবি করে আসছেন সেতুর। প্রায়ই ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটে। পথচারীরা বলছেন, আবরার, রাজীবদের মতো কারও প্রাণ না গেলে এখানে পদচারী সেতু দেবে না সিটি করপোরেশন।

সরেজমিনে রোববার (২৮ এপ্রিল) সকাল ৯টার পর মধ্যবাড্ডায় গিয়ে দেখা যায়, ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের বিপরীত পাশের ফুটপাতে জেব্রা ক্রসিং বরাবর দাঁড়িয়ে আছেন ১৪-১৫ জন পথচারী। কিন্তু সড়কে ট্রাফিক সিগন্যাল নেই। দ্রুতগতিতে ছুটছে যানবাহন। প্রায় চার মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও সড়ক পার হতে পারছিলেন না তারা। এক পর্যায়ে কয়েকজন পথচারী হাতের ইশারায় যানবাহনের গতি কমিয়ে একে একে সড়ক পার হন।

সকাল পৌনে ১০টায় মধ্য বাড্ডার হোসেন মার্কেট সিগন্যালে গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। এ মার্কেটের সামনে সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে পথচারীদের পারাপারের ব্যবস্থা রেখেছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু সেখানেও জেব্রা ক্রসিং ও ট্রাফিক সিগন্যাল নেই। দুই পাশ থেকে হাতের ইশারায় যানবাহনের গতি কমিয়ে শত শত পথচারীকে সড়ক পার হতে দেখা যায়। কারও কারও এমন হয়েছে যে এক সেকেন্ড হিসাব এদিক-সেদিক হলে ঘটে যেত দুর্ঘটনা।

এই ক্রসিং দিয়ে নিয়মিত চলাচল করা বেসরকারি চাকরিজীবী জাহিদ আলম বলেন, ‘দেখেন এখান দিয়ে রাস্তা পার হতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। অফিসেও দেরি হয় অনেক সময়। জীবনের ঝুঁকি তো আছেই। কোনো বাহন হাত উঁচু করলেও থামতে চায় না। গায়ের ওপর চলে আসে। প্রতি ঘণ্টায় এখান দিয়ে হাজারো মানুষ পার হলেও পদচারী সেতু দেওয়া হয় না। আবরার কিংবা দিয়ার মতো কেউ চাপা পড়ে মারা না গেলে হয়তো দেবেও না।’

যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানে পদচারী সেতু
রাজধানীর কুড়িল থেকে মালিবাগ পর্যন্ত প্রায় ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য প্রগতি সরণির। সরেজমিনে দেখা যায়, এখন সড়কের যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে একটি, নদ্দা মোড়ে একটি, নতুন বাজারে দুটি, উত্তর বাড্ডায় একটি, দক্ষিণ বাড্ডায় একটি, মালিবাগ আবুল হোটেল এলাকায় একটি পদচারী সেতু রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজারের বাঁশতলা সংলগ্ন একটি ও আবুল হোটেলের সামনের পদচারী সেতুতে তেমন পথচারী দেখা যায়নি। বাড্ডা লিংক রোডের গুদারাঘাট সংলগ্ন পদচারী সেতু দিয়ে মানুষজন পার হতে দেখা যায় খুবই কম।

আবার ভিন্ন চিত্র প্রগতি সরণির বাড্ডার কনফিডেন্স সেন্টার, মধ্যবাড্ডার হোসেন মার্কেট, ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের সামনে, লিংক রোড, রামপুরা বাজার এলাকায় প্রচুর মানুষকে ব্যস্ত সড়কে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার হতে দেখা গেছে। অথচ এসব পয়েন্টে পদচারী সেতু সময়ের দাবি।

গুলশানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে মধ্যবাড্ডার আদর্শনগরের বাসিন্দা শাখাওয়াত হোসেন। রোববার (২৮ এপ্রিল) সকালে মধ্যবাড্ডার প্রগতি সরণি পার হয়ে অফিসে যাচ্ছিলেন তিনি। আলাপকালে শাখাওয়াত বলেন, ‘প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে প্রগতি সরণি পার হয়ে অফিসে যাওয়া-আসা করতে হয়। এতে প্রায়ই পথচারীদের দুর্ঘটনার কবলে পড়তে দেখি। কোনদিন যে নিজে দুর্ঘটনার শিকার হই, এ আতঙ্ক মনে কাজ করে। গুদারাঘাটের মতো অনেক পদচারী সেতু ব্যবহার হয় না। সেগুলো তুলে নিয়ে প্রয়োজনীয় স্থানে বসানো যেতে পারে’

হোসেন মার্কেটের পেছনের গলিতে একটি ভাড়া বাসায় চার বছর ধরে বাস করেন উত্তর বাড্ডার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে রায়হান আলী। আলাপকালে তিনি বলেন, ‘হোসেন মার্কেটের সামনে চাহিদা থাকার পরও পদচারী সেতু নির্মাণ করছে না সিটি করপোরেশন। অথচ লিংক রোডের গুদারাঘাট এলাকায় একটি পদচারী সেতু রয়েছে। দিনে একজনও পথচারী এ সেতু পার হন না।’

তার কথার সত্যতা পাওয়া যায় গুদারাঘাট গিয়ে। পদচারী সেতুতে ওঠার সিঁড়িও বন্ধ করে হকাররা তাদের মালামালের পসরা সাজিয়েছেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কোনো পথচারীকে সেতুটি ব্যবহার করতেও দেখা যায়নি। আবার নতুনবাজার অর্ধ কিলোমিটারের মধ্যে দুটি সেতু। একটি ব্যবহার হলেও বাঁশতলা সংলগ্ন পদচারী সেতুটি খুব বেশি মানুষকে ব্যবহার করতে দেখা যায়। একটি ঠিক পথচারী পারাপারের পয়েন্টে নির্মিত না হওয়ায় ব্যবহার অনেকটা কম।

পথচারীরা ব্যবহার না করলে এ জায়গায় কেন পদচারী সেতু স্থাপন করা হয়েছিল, তা জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাসেম বলেন, ‘পদচারী সেতু স্থাপনের বিষয়টি ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগ দেখে।’

নগরের কোথায় কী অবকাঠামো উন্নয়ন হবে তা নগর পরিকল্পনা বিভাগের পরিকল্পনার দায়িত্ব বলে জানান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘নগরে পরিকল্পনামাফিক কিছুই হয় না। ফলে দেখা যায় এক কিলোমিটারে চারটি পদচারী সেতু। আবার চার কিলোমিটারে একটাও নেই।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকায় সবচেয়ে বেশি মানুষ হাঁটে। কিন্তু রাস্তা পারাপারে পর্যাপ্ত পদচারী সেতু নেই। আর যেসব জায়গায় জেব্রা ক্রসিং আছে, সেখানে ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা নেই। ফলে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার।’

উত্তর বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা ও দক্ষিণ বাড্ডা এলাকাটি ডিএনসিসির ২১ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাসুম গণি বলেন, ‘প্রগতি সরণির মধ্যবাড্ডায় হাজারো পথচারী ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পার হন। ওই দুটিসহ পৃথক চারটি স্থানে পদচারী সেতু নির্মাণে ডিএনসিসিতে আবেদন করেছিলাম। ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটি ও ব্র্যাক ইউনির্ভাসিটির সামনে দুটি পদচারী সেতু অনুমোদন পেলেও মধ্যবাড্ডায় তা হয়নি। এখন আলাদা প্রকল্পে যাতে মধ্যবাড্ডায় পদচারী সেতু নির্মাণ করা হয়, বিষয়টি ডিএনসিসি মেয়রকে আবার জানাবো।’

জানতে চাইলে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম সম্প্রতি বলেন, ‘নগরের যেসব সড়কে পথচারীদের পারাপার বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, এমন জায়গায় ক্রমেই পদচারী সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এখন প্রগতি সরণির চারটি স্থানে পদচারী সেতু নির্মাণ কাজ চলছে। মধ্যবাড্ডার হোসেন মার্কেট ও বাড্ডা-গুলশান লিংক রোডের পূর্ব অংশে প্রগতি সরণির ওপর আরও দুটি পদচারী সেতুর চাহিদা আছে। ভবিষ্যতে সেখানেও পদচারী সেতু নির্মাণে পরিকল্পনা আছে।’

ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের মার্চে প্রগতি সরণিতে সড়ক দুর্ঘটনায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী নিহত হন। ওই ঘটনায় পর নগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদচারী সেতু এবং চলন্ত সিঁড়ি নির্মাণে প্রকল্প তৈরির নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি ৩৬টি পদচারী সেতু নির্মাণে ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ট্রাফিক অবকাঠামো উন্নয়নসহ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পের’ প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১৯ কোটি ২৩ লাখ সাত হাজার টাকা।

এ প্রকল্পের অধীনে নগরের বিভিন্ন স্থানে অধিকাংশ পদচারী সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এখন প্রগতি সরণির ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটি, ব্র্যাক ইউনির্ভাসিটি, শাহজাদপুরের কনফিডেন্স সেন্টার, বারিধারা জে ব্লকে আলাদা চারটি পদচারী সেতু নির্মাণাধীন। সূত্র: জাগো নিউজ

প্যা/ভ/ম